লিখেছেন : পরিচয় পাত্র
![]() |
চিত্র: জঁ লুক গোদার |
জেএলজির ইচ্ছামৃত্যুর সামান্য আগে যুক্তরাষ্ট্র এবং ফ্রান্সের মধ্যে উড়ে বেড়াচ্ছিলাম কাকতালীয়ভাবে, যে দুই অঞ্চলের মধ্যে কথোপকথন আধুনিক সিনেমার ইতিহাসের এক অতি গুরুত্বপূর্ণ অংশ, যে দূরত্ব গোদার শুরু থেকেই মানসভ্রমণ করলেও পরের দিকে অনেকসময়েই বাস্তবে পেরোতে চাইতেন না।
(জঁ লুক গোদার : তাঁর সিনেমা আরও জটিল এক স্মৃতি-মিউজিয়াম, তার মধ্যে রয়ে গিয়েছে স্বরের ক্যাকোফোনি আর শরীরের নানা খণ্ড।)
ইতিমধ্যে কলকাতার খবর কাগজ-লিটম্যাগ-সোশ্যাল মিডিয়ায় স্ববাসী-প্রবাসী সবাই গোদারকে শালগ্রাম শিলা করে তুললেন। তবে এ জন্য শুধুই তাঁদের দোষী করা চলে না। এই রহস্যময় মানুষটি বরাবর সবাইকে ফাঁকি দিয়ে এসেছেন। দেখলাম গার্ডিয়ানের চিত্রসাংবাদিক গোদার বিষয়ক রচনায় ফের ওঁর তথাকথিত অ্যান্টিসেমিটিজমের প্রসঙ্গ নিয়ে এসেছেন, যেমনটা সাংবাদিকদের কাছে প্রত্যাশিত। মিডিয়ার সঙ্গে এই বিস্ফোরক লোকটির সুসম্পর্ক ছিল বলা চলে না, ফিল্ম ফেস্টিভ্যাল নামক প্রতিষ্ঠানটিও ওঁকে কোনদিন গিলে ফেলতে পারেনি। নিউ ইয়র্কারের অনেককালের চিত্রসাংবাদিক রিচার্ড ব্রডি এক অতিকায় কুশ্রী জীবনী লিখেছিলেন গোদারের, সেখানে ওঁর বর্ণময় যৌনজীবন এবং অ্যান্টিসেমিটিজম সম্পর্কে খুব উৎসাহ দেখিয়েছিলেন তিনি। এই প্রকাণ্ড বইটিকে সমালোচনায় খণ্ড খণ্ড করে প্রত্যাখ্যান করেছিলেন বেশ কয়েকজন, যাদের মধ্যে আমার এক শিক্ষকও রয়েছেন। সে কহে বিস্তর মিছা যে কহে বিস্তর।
গোদার পরিচালিত কয়েকটি উল্লেখযোগ্য ছবি:-
“Pierrot le fou” (1965), “Contempt” (1963), “Every Man for Himself” (1980), “Masculin Feminin” (1966), “Breathless” (1960), “Goodbye to Language” (2014), “Alphaville” (1965), “Two or Three Things I Know About Her” (1967), “Film Socialisme” (2010), “My Life to Live” (1962), “Week-End” (1967), “Tout Va Bien” (1972).
জঁ-লুক (যাকে আদর করে কোন কোন সিনেফিল বন্ধুকে জঁ-লুসিফার বলতে শুনেছি) তাঁর অতি ধনী, নাৎসি-পুতুল ভিশি সরকারের সমর্থক বলে কথিত পরিবার থেকে চিন্তায় বিচ্ছিন্ন হয়ে গিয়েছিলেন। ফরাসী রক্ষণশীল, নাৎসি-সহানুভূতিশীল বলে খ্যাত হুসার গ্রুপের সাহিত্যিকদের পত্রিকায় একদা লিখতেন গোদার এবং তাঁর বন্ধুরা, আফ্রিকায় ফরাসী কলোনিয়াল যুদ্ধের বিরোধিতা করে বেরিয়ে গিয়েছিলেন সেখান থেকে।
মধ্যপ্রাচ্যের একটি রাষ্ট্র সম্পর্কে তাঁর ব্যক্তিগত রাজনৈতিক অবস্থান ছিল প্রত্যাখ্যানমূলক, সেইটেই তাঁকে ওই কথিত অ্যান্টিসেমিটিজমের দাগায় দেগে দেওয়ার নিউ ইয়র্কীয় ফন্দির মূল কারণ। যদিও তাঁর ছবির বিচরণ ভালটের বেনিয়ামিন থেকে মাহমুদ দারউইশ পর্যন্ত নানাজনকে সঙ্গী করেই। শেষপর্যায়ের গোদার মারাত্মক কঠিন, অত্যন্ত সিজনড সিনেফিলেরও চরম পরীক্ষা নেয় তাঁর ছবি। সে পরীক্ষা ইতিহাসের পরীক্ষা, কেননা সিনেমা নামক মাধ্যমটির ইতিহাস তাঁর মাতৃভাষা, আর বেনিয়ামিনের ইতিহাসচেতনা তাঁর সঙ্গী। ছবির দৃশ্যের পর দৃশ্যে সিনেমার ইতিহাসের সঙ্গে তাঁর সংলাপ, সে সংলাপের সঙ্গী না হতে পারলে, তাকে শনাক্ত না করতে পারলে ছবি দেখা কার্যত অসম্ভব।
প্রথমজীবনের 'ব্যান্ড অব আউটসাইডার্স' এর চরিত্রদের ল্যুভ মিউজিয়ামের মধ্যে দিয়ে সেই উদ্ভ্রান্ত দৌড় গোদারের সঙ্গী হয়ে গিয়েছিল, কিন্তু তাঁর সিনেমা আরও জটিল এক স্মৃতি-মিউজিয়াম, তার মধ্যে রয়ে গিয়েছে স্বরের ক্যাকোফোনি আর শরীরের নানা খণ্ড। পল ক্লীর পেন্টিং থেকে প্রভাবিত ভালটের বেনিয়ামিন যে 'ইতিহাসের এঞ্জেল' এর কথা বলতেন তাকে গোদার বারবার মনে করেছেন, করিয়েছেন। উপকথার ছোট নদী আর ইতিহাসের বড় নদী সবই তাঁর সিনেমা আর স্মৃতির অংশ, ইতিহাস তাঁর সিনেমার 'মোমেন্ট অব ট্রুথ', ইমেজ তাঁর কাছে বিংশ শতাব্দীর অসংখ্য ভয়াবহতার (হলোকস্ট সহ) গ্লানির বাহক। দার্শনিক জিল দ্যলুজ থেকে দ্বিতীয় স্ত্রী ও অভিনেত্রী আন ভিয়াজেমস্কি অনেকেই যে শব্দটি তাঁর ছবি ও ইতিহাসচেতনা বিষয়ে ব্যবহার করেন সেটি 'ডিটোনেটর'।
আমি বরং আমার কালেক্টিভ স্মৃতির কাছে ফিরে যাই। আমার অসংখ্য সিনেফিল-ক্রিটিক বন্ধু নানা অঞ্চলে (ইয়োরোপ, যুক্তরাষ্ট্র, অস্ট্রেলিয়া) বসে কিভাবে গোদারকে এক্সপিরিয়েন্স করেছিলেন প্রথম সে কথা বলে চলেছেন। দেশের ফিল্ম সোসাইটির প্রবীণ স্মরণ করেছেন বম্বের লোকাল ট্রেনে ওঁর ছবির রীল নিয়ে ঘুরে বেড়াবার কথা। আমার একদা কলেজ-ড্রপআউট শিক্ষক লিখেছেন মেলবোর্নে বসে ১৭ বছর বয়সে স্থানীয় এক কলেজে দিনের পর দিন সন্ধেবেলায় তাঁর ছবি দেখার কথা। এইভাবেই সিনেফিলদের এক আশ্চর্য গ্লোবাল কমিউনিটি তৈরি হয়ে যায়, যেমন গোদারের বন্ধু জাক রিভেতের ছবির চরিত্ররা এক অদেখা ষড়যন্ত্রতাড়িত হয়ে প্রায় এক সিক্রেট সোসাইটির মতোই এসে মিলিত হয় এক জায়গায়।

"আমি তাকে ফের খুঁজে পেয়েছি। / কাকে? – মহাকালকে। / সূর্যের সাথে পালিয়ে যাওয়া / সেই সমুদ্রকে।"
—আর্তুর রাঁব্যো (Arthur Rimbaud), “মহাকাল” ( ‘L’Éternité’ )
ভেবে দেখলাম ওই ১৭ বছর বয়সেই আমারও প্রথম গোদার, 'পিয়ের লো ফ্যু' ( Pierrot le Fou ) । বয়ঃসন্ধিতে যে ছবি আমাকে তার বিপজ্জনক কৃষ্ণগহ্বরের দিকে টেনে নিয়ে যাবে, দিব্যোন্মাদ করে দেবে। কেননা গোদারের প্রথমজীবনের ছবিগুলি, মে '৬৮ র আগ পর্যন্ত, জনপ্রিয় ছবির নানা উপাদানকে সপাটে আত্মসাৎ করেই তার অসংখ্য আপাত পরস্পরবিরোধী চিন্তা শিশুর মতো ছড়িয়ে রাখে। এই ছবিগুলি একইসঙ্গে তীব্রভাবে ব্যক্তিগত এবং কালেক্টিভ, জনপ্রিয় সিনেমার চেহারা তার রয়েছে এবং নেই, তার প্রেম-অপ্রেম একই সঙ্গে ক্রিয়াশীল, তার বিয়োগান্ত প্রেমের তীব্র বিষাদ আর চটুল পরিহাসকে একইসঙ্গে তছনছ করে দেয় তুমুল হিংসা। আমার দেখা প্রথম গোদারের ছবির শুরু যেমন ভেলাসকেসের চিত্রচর্চায়, আর আত্মহত্যাময় শেষ আর্তুর র্যাঁবোয়, সেই "ইট ইজ ফাউণ্ড এগেন/ উইথ ইটার্নিটি/হোয়েন দ্য সী হ্যাজ গন/উইদ দ্য সান।" "আমি তাকে ফের খুঁজে পেয়েছি। / কাকে? – মহাকালকে। / সূর্যের সাথে পালিয়ে যাওয়া / সেই সমুদ্রকে।" : মহাকাল ( ‘L’Éternité’ ), আর্তুর রাঁব্যো (Arthur Rimbaud)
“A film about absorption: shadow absorbs light a dozen times (the fades to black); death absorbs life. Likewise Godard absorbs the world and is finally himself absorbed by his creation.”
আসল কথাটা জঁ-অঁদহে ফিয়েশি ( Jean-André Fieschi ) অনেক দশক আগে লিখেছিলেন কাইয়ে দ্যু সিনেমায় ( Cahiers du Cinéma ), জেএলজি আসলে এক ভ্যাম্পায়ার ছিলেন, কেননা ভ্যাম্পিরিজম সিনেমা ও সাহিত্যের শ্রেষ্ঠ মিথগুলির একটা। "(তাঁর) ছবি আদতে অ্যাবসর্পশন বিষয়ক, সেখানে ছায়া টেনে নেয় আলোকে (আর ফেড করে যায় কালোয়), মৃত্যু টেনে নেয় জীবনকে। তেমনি গোদার শুষে নেন পৃথিবী, আর অন্তিমে তিনি নিজে তাঁর সৃষ্টিতে বিলীন হয়ে যান।"