"সিনেমাফ্যামিলি" পত্রিকার পঞ্চম বর্ষ প্রথম সংখ্যা প্রকাশিত হয়েছে। সংগ্রহ করুন। এখান থেকে-- CLICK HERE

হরিধন মুখার্জী : গানের জন্য রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের হাতে উপহার পেয়েছেন কাঁথাস্টিচ চাদর ( Actor Haridhan Mukherjee was gifted a katha-stich by Rabindranath Tagore )

(‘আলিবাবা’ নাটকের জন্য মেয়ে সেজেছিলেন। মর্জিনা চরিত্রটির জন্য। হাতিবাগান বাজারে আলু বেচেছেন। সত্যজিতের ছবিতে অভিনয় করেছেন। আর সেদিনের দীনবন্ধু হয়ে উঠলেন হরিধন মুখার্জী।)

লেখা : CinemaFamily Desk


রিধন মুখোপাধ্যায় বাংলা ছায়াছবির দিকপাল এক বিস্মৃতপ্রায় অভিনেতা। হরিধন মুখার্জীর আসল নাম ছিল দীনবন্ধু মুখার্জী। রামায়ণ গান থেকে থিয়েটার আর থিয়েটার থেকে সেলুলয়েডে যাত্রার এক অন্যরকম জীবন ছিল হরিধন মুখার্জীর। যাঁকে আপামর বাঙালি আজ প্রায় ভুলতে বসেছে।

• জন্ম :

দীনবন্ধু নামের ছেলেটিই অভিনয়ের গুণে একদিন হয়ে উঠলেন হরিধন মুখার্জী। উত্তর ২৪ পরগনার গোবরডাঙার খাঁটুয়া গ্রামে ১৯০৭ সালের ১০ নভেম্বর তাঁর জন্ম। দীনবন্ধুর বয়স যখন দুই, বাবা ভুবনমোহন চলে গেলেন পরপারে। দুই ভাই আর মা গিরিবালা দেবীর কষ্টের সংসার। কিন্তু দীনবন্ধুর পড়াশোনায় তার প্রভাব পড়তে দেননি মা। শ্যামবাজার এভি স্কুলে পড়াশুনো করছিলেন। সেখানকার সেক্রেটারি নট-নাট্যকার অমৃতলাল বসু। স্কুলের বার্ষিক অনুষ্ঠানে ‘সিদ্ধার্থের গৃহত্যাগ’ নাটকের রিহার্সালে ছোট্ট দীনবন্ধুর অভিনয় দেখে তিনি খুব প্রশংসা করলেন।

• স্কুল ছেড়ে লেবেঞ্চুসের ব্যবসা :

সংসারে খুব টানাটানি। স্কুলে পড়তে পড়তেই লেবেঞ্চুসের ব্যবসা শুরু করলেন। স্কুলের বন্ধুদের মধ্যে ক্যান্ডি বেচে ভালো লাভও করলেন। বয়স তখন এগারো বারো। ব্যবসায় লাভ দেখে ঠিক করলেন ব্যবসাই ভবিষ্যতে করবেন। স্কুল ছেড়ে দিয়ে নেমে পড়লেন ব্যবসায়। যদিও চলল না লেবেঞ্চুসের ব্যবসা।

• দিনে আলুর ব্যবসা আর রাতে সঙ্গীত চর্চা :

এরপরে শুরু করলেন সাবান-পাউডারের কারবার। সে-ও চলল না। ঢেঁকিছাঁটা চালের ব্যবসা শুরু করলেন। সেটাও জমল না। এরপর দাদার বন্ধুর টাকায় শুরু করলেন আলু বেচা। হাতিবাগান বাজারে আলু বেচতেন আর আর সন্ধেয় থিয়েটার, কবিগান, কীর্তন, পাঁচালির আসরে উপস্থিত হতেন। তার যে অভিনয়ের খুব শখ। গানের গলাও ছিল। যে কোনো গান সহজেই সুর বুঝে গাইতে পারতেন। আর রামায়ণ গান ছিল তার সবচেয়ে পছন্দের। তাই একদিন রামায়ণ গানের দল খুলে ফেললেন। সাথী ছিল ডালিমতলায় গরিব পাড়ার ছেলেমেয়েরা। দীনবন্ধুর সেই গানের দলই জনপ্রিয়তা আর ভক্তিরসের গুণে সকলের কাছে হয়ে উঠলেন ‘হরিধন’। 

বায়ু পরিবর্তন করতে পুরী বেড়াতে নিয়ে গিয়েছিলেন। একদিন অবসরে সমুদ্রতীরে বসে সুর ধরেছেন। সেখানে হাজির আশুতোষ মুখোপাধ্যায়। সঙ্গে ছিলেন কাশিমবাজারের মহারাজা মণীন্দ্রচন্দ্র নন্দী। তাঁরা হরিধনের গান শুনে খুব খাতির করে বাড়িতে ডেকে নিয়ে গেলেন। গান শুনলেন। 

• গান শুনে রবি ঠাকুর কাঁথা স্টিচের কাজ করা চাদর দিয়েছিলেন :

হরিধনের গান শোনার জন্য চারিদিকে ডাকডাকি শুরু হোলো। একদিন সরস্বতী পুজোয় এনআরএস হাসপাতালে (তখন ক্যাম্পবেল হাসপাতাল) গান গাওয়ার ডাক পেলেন। গানের আর আলুর ব্যবসা চলছিল সাথে সাথেই । কিন্তু সঙ্গীত চর্চা ভালো করে করবেন বলে এরপর একদিন আলুর ব্যবসা ছেড়ে দিলেন। যদিও পেটের টানে অর্ডার সাপ্লাইয়ের ব্যবসা শুরু করতে হোলো। এসবের মাঝেই পরিচয় হয়ে গেল অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সঙ্গে। হাজির হলেন বিখ্যাত জোড়াসাঁকোর ঠাকুরবাড়িতে। ঠাকুরবাড়িতে ‘মুক্তধারা’ নাটকে তিনি ‘ধনঞ্জয় বৈরাগী’র রোল প্লে করলেন। মুখে ছিল ‘রইল বলে রাখলে কারে’ গান। হরিধনের গান শুনে রবি ঠাকুর খুব খুশি হয়েছিলেন। আর উপহার দিয়েছিলেন কাঁথা স্টিচের কাজ করা গায়ের ঢাকা !

• পাঁচালি গানের দল, কলকাতায় প্রথম :

হরিধন মহাত্মা গাঁধীকেও গান শুনিয়েছিলেন। সেবার দেশবন্ধু পার্কের সভায় এসেছিলেন গাঁধী। সিদ্ধার্থশঙ্কর রায়ের মা, দেশবন্ধুর মেয়ে, অপর্ণা দেবী তাঁর কীর্তন শুনে রুপোর মেডেল দিয়েছিলেন। এরপর হরিধন কীর্তন আর পাঁচালি গানের দল গড়লেন। বালিকাদের নিয়ে গড়া সেই দল কলকাতায় প্রথম।

• মেয়ে সেজে অভিনয় :

হরিধনবাবু গানের গলা থাকলেও মনের একটা অন্যতম চাওয়া ছিল অভিনয় করবেন। বন্ধু অসিতের বাড়িতে একদিন দল তৈরি হল ‘দীনবন্ধু সম্মিলনী’। নাটক শুরু হোলো। এর মাঝেই নাটকের চরিত্রের জন্যই নারীর প্রয়োজন হোলো। তিনি নিজেই নারী সেজে অভিনয় শুরু করলেন। ‘সুখদা’ সেজে ‘পথের শেষে’ নাটকে অভিনয় শুরু। এরপর ‘আলিবাবা’য় ‘মর্জিনা’ সাজলেন। এছাড়াও ‘বিবাহ বিভ্রাট’-এ ঝি, ‘জোরবরাত’-এ ঘটকি ও ‘মানময়ী গার্লস স্কুল’-এ নীহারিকা সেজে অভিনয় করেছিলেন। 

• পেশাদার রঙ্গমঞ্চ পেলেন শিশির ভাদুড়ীর ডাকে :

পেশাদার রঙ্গমঞ্চে অভিনয় শিশির ভাদুড়ীর ডাকে। শ্রীরঙ্গমে ‘মায়া’ নাটকে অভিনয় করার ডাক পেলেন। পঞ্চাশের মন্বন্তরের দোরগোড়ায় পেশাদার রঙ্গমঞ্চ থেকে সেই শুরু করার পর টানা পঞ্চাশ বছর নাট্যভারতী, স্টার সহ নানান থিয়েটারে অভিনয় করেছেন। তার করা সেরা নাটকের কয়েকটি হোলো ‘কবি’, ‘উল্কা’, ‘আদর্শ হিন্দু হোটেল’, ‘আমি মন্ত্রী হব’, ‘সাহেব বিবি গোলাম’ ইত্যাদি।

• চলচ্চিত্রে অভিনয় :

১৯৪৩ সালে অমৃতলাল বসুর নাটক নিয়ে করা ‘খাসদখল’ সিনেমায় করলেন মোসায়েবের চরিত্র করলেন হরিধন। শৈলজানন্দ মুখোপাধ্যায়ের ‘শহর থেকে দূরে’ ছবিতে খুব ছোট্ট কিন্তু প্রভাবশালী বাউল চরিত্রে অভিনয় করেছিলেন। ১৯৪৪-এ দেবকী বসুর ‘সন্ধি’ ছবিতেই নিজেকে কমেডিয়ান হিসেবে প্রমাণিত করেছিলেন হরিধন। ১৯৫৩ সালে বিখ্যাত ‘সাড়ে চুয়াত্তর’ ছবিতে তুলসী, ভানু, জহররের সাথে অভিনয় করলেন হরিধন। 

• সত্যজিত রায়ের শুটিংয়ে ফ্লোরে দেরিতে এসেছিলেন :

সত্যজিৎ রায় রত্ন চিনে নিতে পারতেন। আর তাই তাঁর কয়েকটি ছবিতে তিনি ডেকে নিয়েছিলেন হরিধন মুখার্জীকে। ১৯৫৮ সালে প্রথম ডাক পেলেন এল সত্যজিৎ রায়ের ‘পরশপাথর’ ছবিতে অভিনয় করতে। সে এক কাণ্ড করেছিলেন তিনি। প্রথম সাক্ষাৎ হবে। হরিধন জানতেন সত্যজিৎ ঢ্যাঙা মানুষ। স্টুডিয়োর বাইরে ওরকম একজনকে দেখে সত্যজিৎ ভেবে বেশ গল্প করে একটু দেরি করেই ফ্লোরে গিয়েছিলেন। ওদিকে ভিতরে অপেক্ষা করছেন সত্যজিৎ। তাঁর শুটিংয়ে দেরি করে আসার কথা কেউ ভাবতেও পারত না। ১৯৬২ সালে ‘কাঞ্চনজঙ্ঘা’ ছবিতে আবার ডাক পেলেন হরিধন। তারপরে ১৯৬৫ সালে ‘মহাপুরুষ’ ছবিতে তিনি বুঁচকির গণেশ মামার চরিত্রে অভিনয় করলেন। ১৯৬৮ ‘গুপী গাইন বাঘা বাইন’-এ গাঁয়ের বুড়োর চরিত্রে অভিনয়। গুপীকে বলছেন, ‘‘একখানা গেয়ে শুনিয়ে দাও না!’’ সত্যজিতের ছবিতেও তিনি নিজের মত করেই অভিনয় করতেন। ১৯৮০ সালে ‘হীরক রাজার দেশে’ ছবিতে রাজার জ্যোতিষের অভিনয় করলেন।

• সিনেমায় প্লেব্যাক :

হরিধন গানের মানুষ। কিন্তু সিনেমায় অভিনয় করতে গিয়ে শুধু অভিনয়ে থেমে থাকলেন না। সিনেমায় প্লেব্যাক করলেন। ১৯৭৪ সালে তরুন মজুমদারের পরিচালিত ‘ফুলেশ্বরী’ ছবিতে গান গাইলেন— ‘আমি তোমায় বড় ভালবাসি’। এছাড়াও ‘সন্ধি’তে গেয়েছিলেন। নীরেন লাহিড়ীর ‘ভাবীকাল’, ‘এন্টনী ফিরিঙ্গী’ আর ‘ভোলা ময়রা’ ছবিতেও গেয়েছেন। ফুলেশ্বরীর গানের সুরও তাঁরই দেওয়া। বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্রের ডাকে আকাশবাণীর রেডিয়ো নাটকেও কণ্ঠ দিয়েছিলেন।

• পুরস্কার ও সম্মান :

হরিধন তার কাজের সম্মান পেয়েছিলেন দর্শক আর শ্রোতাদের থেকে। শেষ বয়সে পেলেন নানান সরকারি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের সম্মান। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়, বিএফজেএ, পশ্চিমবঙ্গ নাট্য অ্যাকাডেমি, ফেডারেশন অব ফিল্ম সোসাইটিজ় অব ইন্ডিয়া, যোগেশ মাইম অ্যাকাডেমি থেকে তার কাজের স্বীকৃতি হিসেবে সম্মান ও পুরস্কার পেয়েছেন। রাজ্যপাল রঘুনাথ রেড্ডি তাঁকে দিলেন সঙ্গীত নাটক অ্যাকাডেমি পুরস্কার।

• মৃত্যু :

২০০৪ সালের ২৬ ডিসেম্বর পৃথিবীর এই বিরাট রঙ্গমঞ্চ থেকে চিরদিনের জন্য বিদায় নিলেন হরিধন মুখার্জী। 



* তথ্যসূত্র : ইন্টারনেট 

© CinemaFamily. All rights reserved. Developed by Jago Desain