"সিনেমাফ্যামিলি" পত্রিকার পঞ্চম বর্ষ প্রথম সংখ্যা প্রকাশিত হয়েছে। সংগ্রহ করুন। এখান থেকে-- CLICK HERE

ভিলেজ রকস্টার : ছায়াগাঁও থেকে লস এঞ্জেলস

গয়না বিক্রী আর কিছু ধার। কেনা হয়ে গেল একখানা আস্ত ক্যামেরা। ২০১৬ সালে প্রথম পূর্ণ দৈর্ঘের চলচ্চিত্র ‘অন্তদৃষ্টি’ থেকে লস এঞ্জেলেস এ ‘ভিলেজ রকস্টার’

লিখেছেন : দীপালোক ভট্টাচার্য 

Village Rockstar Rima Das Oscar cinemafamily

ডিজিটাল প্রযুক্তির ব্যবহার শুরু হওয়ার পর থেকে  চলচ্চিত্র নির্মানের যে ধারাটি ক্রমেই বিকশিত হয়ে মহীরুহের আকার নিয়েছে, সেটি হল স্বাধীন চলচ্চিত্র নির্মান। একটি ভালো মানের ডি এস এল আর ক্যামেরা, একটি ট্রাইপড, শব্দ রেকর্ডিংএর যন্ত্র, ছবি সম্পাদনার জন্য একটি উপযুক্ত কম্পিউটার, যারা কোনোদিন ক্যামেরার সামনে অভিনয় করেনি – এমন আটপৌরে কলাকুশলী – এতটুকু উপকরণ দিয়েই যে বানিয়ে ফেলা যায় আস্ত একটা পূর্ণ দৈর্ঘের ছবি, এটা একসময় কল্পনাতীত ছিল।

এতটুকু অবধি যদিও বা ঠিক ছিল; আমরা প্রবল বিষ্মিত হলাম তখন যখন উপরে লেখা উপায়ে তৈরি একটা ভারতীয় ভাষার ছবির প্রিমিয়ার শো হয় টরেন্টো চলচ্চিত্র উৎসবে, সে ছবি তিনটি জাতীয় পুরষ্কার সহ গোটা পৃথিবী জুড়ে চুয়াল্লিশটা পুরষ্কার জেতে আর এত ছবির মাঝে এই আটপৌরে ছবিটা অস্কারের মঞ্চে দেশের হয়ে প্রতিনিধিত্ব করার জন্য নির্বাচিত হয়।

গয়না বিক্রী আর কিছু ধার। কেনা হয়ে গেল একখানা আস্ত ক্যামেরা। কয়েকটা শর্ট ফিল্মের মাধ্যমে হাত পাকিয়ে ২০১৬ সালে  প্রথম পূর্ণ দৈর্ঘের চলচ্চিত্র ‘অন্তদৃষ্টি’ থেকে লস এঞ্জেলেস এ ‘ভিলেজ রকস্টার’


হ্যাঁ, ‘ভিলেজ রকস্টার’ ছবিটার কথাই বলছি; যে ছবির প্রযোজনা, পরিচালনা, সিনেমাটোগ্রাফি, সম্পাদনা – পুরোটাই একা হাতে সামলেছেন গুয়াহাটির বাসিন্দা ছত্রিশ বছর বয়সী রিমা দাস। ছবি পরিচালনায় আসবেন, এমন পরিকম্পনা ছিল না সেভাবে। বরং অনেকের মত অভিনেত্রী হওয়ার স্বপ্ন নিয়ে পারি জমান মুম্বাইয়ে। কয়েকটা নাটকে অভিনয়ের পর হতাশা আসে। আবার ফিরে আসেন নিজের বাড়ি। গুয়াহাটির কাছের ছোট্ট ছায়াগাঁও গ্রামে। ছোটবেলার সিনেমা দেখার অভ্যেসটা আবার চাগার দিয়ে ওঠে। রিমা দেখতে শুরু করেন দেশী বিদেশী নানান ছবি। বুঝতে শুরু করেন সিনেমার নিজেস্ব ভাষা, নিজের মত করে। তারপর মনে হয়, এবার তাহলে মাঠে নামা যেতেই পারে।

এ মাঠে খেলতে গেলে অন্তত একটা উপকরণ চাই। ক্যামেরা। গয়না বিক্রী আর কিছু ধার। কেনা হয়ে গেল একখানা আস্ত ক্যামেরা। কয়েকটা শর্ট ফিল্মের মাধ্যমে হাত পাকিয়ে ২০১৬ সালে  প্রথম পূর্ণ দৈর্ঘের চলচ্চিত্র ‘অন্তদৃষ্টি’, যে ছবি প্রৌঢ়ত্বের দোরগোড়ায় পৌছানো এক চরিত্রের অতীতকে নিয়ে বেঁচে থাকার গল্প বলা হয়েছে। 
নিজের গ্রামে একদিন রিমার চোখে পড়ে একদল শিশুর মিছিমিছি গিটার বাজিয়ে গান হাওয়ার দৃশ্য। এই দৃশ্যপটই ‘ভিলেজ রকস্টার’ ছবির প্রধান অনুঘটক হিসেবে কাজ করে। তৈরী হয় চিত্রনাট্য। ক্ষুদে অভিনেতারা সকলেই রিমার গ্রামেই থাকে। রিমার এক তুতো বোন(ভানিতা দাস) মূখ্য চরিত্র ধুনুর ভূমিকায় অভিনয় করে এবং সেরা শিশু অভিনেতার জাতীয় পুরষ্কারটি ছিনিয়ে নেয়। আরেক বোন মল্লিকা দাস শব্দ রেকর্ডিংএর কাজ করে জিতে নেয় ‘অন লোকেশন সাউন্ড রেকর্ডিং’ এর জাতীয় পুরষ্কার। 

ক্যানোন ৫ ডি ক্যামেরা, একটিমাত্র লেন্স, সামান্য কিছু আলোর সরঞ্জাম, ট্রাইপড – এসব নিয়েই শুরু হয় শুটিং। রিমার ছায়াগাঁও বিভিন্ন আঙ্গিকে ধরা হয় ক্যামেরায়। কখনো দিগন্ত বিস্তৃত মাঠ, জলাভূমি, গাছগাছালি, কখনো বা গ্রামের বাড়িঘরই হয়ে ওঠে সিনেমার সেট। কলাকুশলীরা প্রথমবার ক্যামেরার সামনে অভিনয় করছে। কিন্তু সবাই পরিচালকের পরিচিত আপনজন হওয়ায় ক্যামেরার অস্তিত্বকে ভুলে গিয়ে নিজেরা যা করে, প্রাণোচ্ছলভাবে সেটাই করে গেছে। আসামের কামরূপী ‘ডায়ালেক্ট’ এ সাবলীলভাবে সংলাপ বলে গেছেন এই ক্ষুদেরা নিজেদের মত করেই। ছায়াগাঁওয়ের মেঠো সুর, বাতাসের শনশন, জলের শব্দ – এসবই ধরা পরেছে মল্লিকার শব্দগ্রাহক যন্ত্রে। 

‘ভিলেজ রকস্টার’ (Village Rockstarছবির গল্প আবর্তিত হয়েছে ধুনুকে কেন্দ্র করে। ছবির এই  দরিদ্র পরিবারের মেয়েটির খুব শখ একটা গিটারের, যে গিটার দিয়ে তাদের দামাল ছেলে মেয়েদের দল একখানা গানের দল গড়বে। একসময় প্রকৃতির নিয়মে ধুনু কিশোরী হয়। ‘গেছো’ মেয়েটির উপর আরোপিত হয় নানান বিধিনিষেধ। কিন্তু গানের দল গড়ার স্বপ্ন থেমে থাকে না ধুনুদের।   এ ছবি তাদের ইচ্ছাপূরণের গল্প বলে। 

চার বছর ধরে চলা শুটিং শেষে  ‘ভিলেজ রকস্টার’ এর প্রথম প্রদর্শন হয় টরেন্টো আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবে। তারপর নানান দেশের ৭০ টি উৎসবে ৪৪ টি পুরষ্কারজয়। তিনটি বিভাগে জাতীয় পুরষ্কার লাভের পর অনেক নামজাদা ছবিকে পেছনে ফেলে  লস এঞ্জেলেসের কোডাক থিয়েটারে প্রদর্শনের জন্য অপেক্ষায় আছে রিমা আর তার দলবল।

তবে আক্ষেপের বিষয় এই যে, এই ছবি বড়পর্দায় দেখার সুযোগ সেভাবে হয় নি আমাদের। মাত্র সাতটা শহরের কিছু প্রেক্ষাগৃহে ২০১৮ সালের সেপ্টেম্বরে মুক্তি পায় ‘ভিলেজ রকস্টার’। দেশ বিদেশের নানান উৎসবে যে ছবি গুণীজনমহলে প্রশংসিত, নিজের দেশের চলচ্চিত্রমোদী জনতার সেভাবে সুযোগ হয়নি সে ছবি দেখার, এটাই আক্ষেপ পরিচালক রিমা দাসের।

আর এর সাথেই স্বাধীন চলচ্চিত্র কর্মীদের প্রেক্ষাগৃহে নিজেদের ছবি প্রদর্শন নিয়ে ক্ষোভ আর বঞ্চনার দীর্ঘশ্বাস গাঢ়তর হয়েছে। নিজের ঘাম আর রক্তের বিনিময়ে করা একটি চলচ্চিত্র তার গুনমানের জোরে নানান ফিল্ম ফেস্টিভ্যালে ঝড় তুললেও, প্রেক্ষাগৃহ কিংবা মাল্টিপ্লেক্সে সে ছবির ভবিষ্যৎ নিয়েও উঠেছে প্রশ্ন। রিমা দাস এবং তার ছবির ব্যাপারে জাতীয় গণমাধ্যমে আলোচনা হয়েছে সেটির জাতীয় পুরষ্কার প্রাপ্তির পর। আর তখন থেকেই এই ছবি মুক্তির ব্যাপারে আগ্রহী হয় অনেকে। 

তবে এসব নিয়ে ভাবার মোটেই সময় নেই রিমা দাসের। তার পরবর্তী ছবি ‘বুলবুল ক্যান সিং’ ইতিমধ্যে গুনীজনের নজর কেড়েছে ছবিটি। মুম্বাই চলচ্চিত্র উৎসবে এটি শ্রেষ্ঠ ভারতীয় ছবি হিসেবে নির্বাচিত হয়েছে সম্প্রতি। ‘ভিলেজ রকস্টার’এর মতই এ ছবিও নির্মিত হয়েছে তার নিজের গ্রামের অভিনেতাদের নিয়ে। চিত্রনাট্য, সিনেমাটোগ্রাফি, সম্পাদনা, নির্দেশনা, সহ প্রযোজনা – সব কিছুই রিমা সামলেছেন একা হাতে। 

শুধু অদম্য জেদ আর ইচ্ছাশক্তিকে পুঁজি করেও যে অতিক্রম করা যায় একের পর এক মাইলফলক, এটা প্রমান করেছেন রিমা। স্বাধীন চলচ্চিত্র নির্মান শিল্পীরা অনুপ্রানিত হোক রিমার কাজ দেখে, ডিজিটাল প্রযুক্তির সাহায্যে স্বল্প খরচে ছবি তৈরী একটা বিল্পবের চেহারা নিক, শহর-গ্রাম- মফস্বলের ছবি করিয়েরা আবিষ্কার করুক ছবির নতুন ভাষা ও আঙ্গিক – এর চেয়ে বড় চাওয়া আর কী হতে পারে? 
(‘গোডো আসবেই’ লিটিল ম্যাগাজিন, দ্বিতীয় বর্ষ, প্রথম সংখ্যা, প্রকাশ – ১৯ শে জুন, ২০১৯)

About Author:

Deepalok Bhattacharya:

দীপালোক ভট্টাচার্য, পেশায় স্কুল শিক্ষক, নেশা সাহিত্য, চলচ্চিত্র পরিচালনা। হলদিবাড়ি থেকে প্রকাশিত প্রথম সিনেমা বিষয়ক পত্রিকা ও ই-ম্যাগাজিন “সিনেমাফ্যামিলি”-র সহ-সম্পাদক। “Tomato Story”  ও “কাদো খেলা” নামের দু'টি তথ্যচিত্র পরিচালনা করেছেন। লিখেছেন “ডানা ভাঙা ফড়িং” নামের একটি গল্পগ্রন্থ।

Follow him @ ফেসবুক | Facebook

© CinemaFamily. All rights reserved. Developed by Jago Desain