লিখেছেন : দীপালোক ভট্টাচার্য
![]() |
Offside, 2006 |
ছবির নাম: অফসাইড ( Offside / 2006 )
পরিচালক : জাফর পানাহি ( Jafar Panahi )
দেশ: ইরান ( Iran )
ভাষা: পারশিয়ান
মুক্তির বছর: ২০০৬
কে করল অফসাইড? প্রতিপক্ষই বা কে? কখন রেফারি তার বাঁশি ফুঁকে জানান দিল, অফসাইড হয়েছে? এরকম নানা প্রশ্ন কিলবিল করতে থাকে মাথায় ছবিটা শেষ হবার পরও। বিশেষত পরিচালকের নাম যখন জাফর পানাহি। এমন একটা দেশে ছবিটা বানানো, যেখানে ১৯৭৯ সালের ইসলামিক বিপ্লবের পর থেকে মেয়েদের ফুটবল মাঠে যাওয়া নিষিদ্ধ। মাঝে একবার ইরানের প্রেসিডেন্ট মশাই মাহমদ আহমাদিনেজাদ চেষ্টা চরিত্র করেছিলেন, এই নিষেধাজ্ঞা তুলে দেওয়ার ব্যাপারে। কিন্তু উলেমারা যে বেশ ক্ষমতাশালী সে দেশে। তাদের চটাবার উপায় আছে? তো পানাহি সাহেব তার ছবির বিষয় নির্বাচন করতে গিয়ে বেছে নিলেন গুটি কয়েক দামাল মেয়ের ফুটবল ম্যাচ দেখার ঘটনাকে।
(এই মুহুর্তে চলছে কাতার বিশ্বকাপ 2022. ফুটবলের মহা উৎসব। এই মরসুমে দেখে নেওয়া যাক ইরানের পরিচালক জাফর পানাহির ফুটবলের আবহ নিয়ে নির্মিত ২০০৬ সালের ছায়াছবি "অফসাইড", Offside, 2006)
ছবির প্রথমেই দেখা গেল ফুটবল সমর্থকরা গাড়ি বোঝাই করে চলছেন ষ্টেডিয়ামের উদ্দেশ্যে। ইরান বনাম বাহরিনের বিশ্বকাপ ফুটবলের বাছাইপর্বের ম্যাচ দেখতে। একটা দেশ বিশ্বকাপ খেলবে কি খেলবে না, এই প্রশ্নে ফুটবল পাগলেরা জ্বরে আক্রান্ত হবেই, তাই না? তো ছবির প্রথমে আমরা দেখি এক বাবা তার ফুটবল পাগল মেয়েকে হন্নে হয়ে খুঁজে চলেছেন। তিনি জানেন, মেয়ে ঠিক যাবে ষ্টেডিয়ামে। লুকিয়ে চুরিয়ে ভেতরে ঢোকার চেষ্টা করবে। সমর্থকবোঝাই বাসগুলিতে চিরুনিচল্লাশি চালিয়ে খান্ত হলেন বাবা। এদিকে মেয়ে ছেলেদের মতন পোষাক পরে গালে দেশের জাতীয় পতাকার স্টিকার সেঁটে দিব্বি চলছে খেলা দেখতে। ব্ল্যাকে অনেক বেশি মূল্যে টিকিট কেটে ষ্টেডিয়ামে ঢুকতে গিয়েই বিপত্তি। ঢোকার মুখে শরীর তল্লাশী চালায় নিরাপত্তাবাহিনীর লোকজন। মেয়েটি চেঁচিয়ে ওঠে, "দোহাই আপনাদের, শরীরে হাত দেবেন না। এতেই বিপত্তি। সোজা চালান পুলিশের হেফাজতে। ষ্টেডিয়ামের পেছন দিকটায় ব্যারিকেট করে নির্মিত আস্থায়ী কারাগারে ঠাঁই হয় মেয়েটির। সাথে জোটে আরো অনেকে। নাকি সুরে কাঁদতে থাকা কিশোরী থেকে সিগারেটে সুখটান দেওয়া দামাল মেয়ে-- সবারই আবদার খেলা দেখতে দিতে হবে। দুধের স্বাদ ঘোলে মেটে পুলিশদের ধারাবিবরনীতে। হাস্যরসে সংপৃক্ত নানা দৃশ্য রচিত হয় ছবির পরতে পরতে। বাকিগল্পটুকু বরং তোলা থাক আগ্রহী দর্শকদের জন্য, যারা এখনও অবধি দেখেননি ছবিটা।
আসুন এবারে একটু ছবি তৈরীর গল্প করা যাক। যে দেশে মেয়েরা ফুটবল ম্যাচ দেখার অনুমতি পায়না, সেখানে সেদেশের সেন্সরবোর্ড এরকম একটা স্পর্শকাতর বিষয় নিয়ে ছবি করার অনুমতি দেবেন, এমনটা ভাবার কোন কারন নেই। কিন্তু ছবি যে করতেই হবে পানাহি সাহেবকে। তাহলে উপায়? উনি কী করলেন, সরকারের নির্দিষ্ট দপ্তরে যে চিত্রনাট্য জমা দিলেন, সেখানে আছে পুরুষ দর্শকরা খেলার মাঠে খেলা দেখবে, এমন একটা বিষয় নিয়ে ছবি। পরিচালকের নাম হিসেবেও নিজের নাম না দিয়ে দিলেন সহকারী পরিচালকের নাম। শুরু হল শুটিং। সত্যিকারের খেলার মাঠে শুটিং। সত্যিকারের ফুটবল ম্যাচ। মেয়েগুলির ভূমিকায় অপেশাদার বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রীরা। মূল ম্যাচ সহ মোট উনচল্লিশদিন ধরে চলল শুটিং। লোক জানাজানির ভয় এবং রাস্তাঘাটে শুটিং এর সুবিধার জন্য এবারে প্রথমবারের জন্য ডিজিটাল ফরম্যাট। ছোট্ট ক্যামেরা। ট্রলি-ফলির ঝামেলায় না গিয়ে হাতে ক্যামেরা নিয়েই শুটিং কিন্তু গোলমাল বাধল শেষে। একটা ট্যাবলয়েট খবর করল, জাফর পানাহি শুটিং করছেন ফিল্মের। ব্যাস, সরকার এবারে ছাড়বে না। শুটিং বন্ধ করতে হবে। ফুটেজ বাজেয়াপ্ত করতে হবে। কোনরকমে বেঁচে গেলেন সে যাত্রায়। বার্লিন চলচ্চিত্র উৎসবে মিলল পুরষ্কার। কিন্তু নিজের দেশেই নিষেধাজ্ঞা জারি হল, অফসাইড প্রদর্শন বন্ধ। এদিকে পানাহি সাহেব ডিসট্রিবিয়শনের সমস্ত ব্যাবস্থা করে ফেলেছেন। কী আর করা যাবে। দমার পাত্র নন ইনি৷ পাইরেটেড ডিভিডি ছেয়ে গেল দেশে। দেশের প্রচুর মানুষ দেখে ফেলল অফসাইড। বড় পর্দার স্বাদ মিটল পাইরেটেড ডিভিডিতে।
'ষ্টেডিয়ামে তো অন্যান্য দেশের কত মেয়ে আছে। শুধু আমাদের বেলাতেই যত দোষ, তাই না? ইরানে জন্মেছি বলেই আমাদের ফুটবল মাঠে ব্রাত্য করে রাখা?' এটা 'অফসাইড' ছবির এক চরিত্রের আকুতি। গ্যালারীতে বসে ম্যাচ দেখার আকুতি। মাঠজোড়া দর্শকদের সাথে তীব্র চিৎকারে দেশের হয়ে খেলতে নামা ফুটবলারদের উজ্জীবিত করার আকুতি। কিন্তু সেই আকুতি শুনল আর কে? বরং রাষ্ট্রই বাশি ফুকে বলল, এই মেয়েগুলো অফসাইড করেছে। ছেলেদের সাথে একাসনে বসে ম্যাচ দেখা? হাফপ্যান্ট পরা পুরুষালি ফুটবলারদের চাক্ষুস দর্শন। দাঁড়াও দেখাচ্ছি মজা।
কিন্তু কখন যেন আজান্তেই রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে বাঁশি ফুকে দিয়েছেন পানাহি সাহেব। ফিসফিস করে বলেছেন, এটা অন্যায়। কিন্তু সেই ফিসফিস দর্শকের মস্তিষ্কে কখন যে কলরব হয়ে আছড়ে পরেছে, সেটা টের পাবার জো নেই। আসলে জাফর পানাহি এক অন্য ধাতুতে গড়া মানুষ। ২০১০ সাল। দেশের নিরাপত্তা বিঘ্নিত করা ও ইসলামিক প্রজাতন্ত্রের বিরুন্ধে প্রচার চালানারে দায়ে গৃহবন্দী হলেন পানাহি৷ কুড়ি বছরের জন্য ছবি পরিচালনা সহ সমস্ত রকম ছবি সংক্রান্ত কাজ থেকে আবশ্যিক নির্বাসন ঘোষনা করল ইরান সরকার। গৃহবন্দী দশাতেই ডিজিটাল ভিডিও ফরম্যাটে নিজের জীবনের ডকুমেনটেশন করলেন। ভবিষ্যত ছবির দৃশ্য নির্মান করলেন নিজেই। তার বদ্ধ অ্যাপার্টমেন্টের চার দেওয়ালে। তারপর অতি গোপনে সেই ছবির পেনড্রাইভ পাচার হল। সারা পৃথিবী দেখল 'ইট ইস নট আ ফিল্ম' ।
জাফর পানাহির কোন ছবি আসলে সেই অর্থে ফিল্ম নয়। বলা যেতে পারে, তার সব ছবি জীবনের ডকুমেনটেশন।